ওহুদের যুদ্ধ তিন হিজরি মোতাবেক ৬২৪ সালের শাওয়াল মাসে মুসলমান এবং মক্কার কুরাইশদের মাঝে সংঘটিত হয়। ওহুদ একটি পর্বতের নাম। এই পর্বতের সম্মুখস্থ ময়দানে ওই যুদ্ধ সংঘটিত হয় বলে এর নাম ওহুদ যুদ্ধ।ওহুদের যুদ্ধে কাফিররা যখন পুনরায় আক্রমণ করে আর মুসলমানদের পরাজয় বরণ করতে হয় তখন মহানবী (সা.) সম্পর্কে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে, তিনি (সা.) শহীদ হয়ে গেছেন।
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, মহানবীর (সা.) শাহাদতের ঘটনা এবং কিছু মানুষের বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ার পর সর্বপ্রথম হজরত কাব বিন মালিকের (রা.) দৃষ্টি মহানবীর (সা.) ওপর পড়ে।
তিনি বর্ণনা করেন, আমি শিরস্ত্রাণের মধ্য থেকে তার (সা.) উজ্জ্বল চোখ দু’টি দেখতে পেয়ে উচ্চস্বরে বলি, হে মুসলমানেরা! আনন্দিত হও, কেননা মহানবী (সা.) এখানে আছেন। এটি শুনে মহানবী (সা.) হাতের ইশারায় বলেন, চুপ থাকো। মুসলমানেরা যখন মহানবীকে (সা.) চিনতে পারে তখন মহানবী (সা.) সঙ্গীসাথী নিয়ে গিরিপথের দিকে রওয়ানা হন। যেসব সাহাবি মহানবীর (সা.) চতুষ্পার্শ্বে সমবেত ছিলেন এবং তারা আত্মোৎসর্গের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ইতিহাসে এর কোন দৃষ্টান্ত নেই। তারা পতঙ্গের ন্যায় মহানবীর (সা.) চতুষ্পার্শ্বে ঘুরছিলেন এবং তার জন্য নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছিলেন।
যে আঘাতই আসত সাহাবিরা তা বুক পেতে বরণ করতেন এবং মহানবীকে (সা.) রক্ষা করতেন আর একইসঙ্গে শত্রুর ওপরও আঘাত হানতেন। হজরত আলি (রা.) এবং যুবায়ের (রা.) বহু শত্রুর ওপর আক্রমণ করেন এবং তাদের সারিগুলোকে পিছুহটিয়ে দেন।
হজরত আবু দুজানা (রা.) অনেকক্ষণ পর্যন্ত নিজের শরীর দিয়ে মহানবীর (সা.) শরীর মোবারক আড়াল করে রাখেন আর যে তীর বা পাথরই আসত সেটির সামনে নিজের শরীর পেতে দিতেন। এভাবে তার শরীর তীরের আঘাতে ঝাঝরা হয়ে যায় কিন্তু তিনি (রা.) উফ্ শব্দটিও করেন নি যেন এমন না হয় যে, তার শরীর নড়ে যাওয়ার ফলে মহানবীর (সা.) শরীরের কোন অংশ ঝুঁকির মুখে পড়ে আর কোন তীর এসে তার গায়ে বিদ্ধ হয়।
হজরত তালহা (রা.) মহানবীকে (সা.) রক্ষা করার জন্য অনেকগুলো আঘাত নিজ দেহে বরণ করেছেন এবং এই প্রচেষ্টাতেই তার হাত অসাড় হয়ে সারা জীবনের জন্য অকেজো হয়ে গেছে। কিন্তু এই গুটিকতক নিবেদিতপ্রাণ মানুষ আর কতক্ষণ এমন বিরাট প্লাবনের সামনে টিকতে পারত যা প্রতিটি ক্ষণেই চতুর্দিক থেকে ভয়ানক তরঙ্গের ন্যায় আছড়ে পড়ছিল।
শত্রুদের প্রতিটি আক্রমণের প্রতিটি ঢেউ মুসলমানদেরকে অনেক দূরে বয়ে নিয়ে যেত কিন্তু তীব্রতা কিছুটা কমলেই অসহায় মুসলমানরা যুদ্ধ করতে করতে পুনরায় তাদের প্রিয় মনিবের পাশে এসে জমা হত। কোন কোন সময় তো এমন ভয়ঙ্কর আক্রমণ হত যে, মহানবী (সা.) কার্যত একা থেকে যেতেন। যেমন এমন একটি সময় আসে যখন মহানবীর (সা.) চারপাশে কেবল বারো জন সাহাবী ছিলেন। আবার একবার এমন সময়ও আসে যখন তার সাথে কেবল দু’জন লোকই ছিল।
ওহুদের যুদ্ধের দিন মহানবী (সা.) যখন সাহাবীদের সঙ্গে পাহাড়ে আরোহণ করেন তখন কাফিররাও তার পিছনে পিছনে আসে।
যেমন সহিহ বোখারির রেওয়ায়েত রয়েছে, আবু সুফিয়ান তিনবার চিৎকার করে জানতে চায়, এসব লোকের মাঝে কি মুহাম্মদ (সা.) আছে? তখন মহানবী (সা.) সাহাবীদেরকে উত্তর দিতে নিষেধ করেন। এরপর সে চেঁচিয়ে তিনবার জিজ্ঞেস করে, লোকদের মধ্যে কি আবু কোহাফার পুত্র, অর্থাৎ আবু বকর আছে? পুনরায় তিনবার জিজ্ঞেস করে, এসব লোকের মাঝে কি ইবনে খাত্তাব, অর্থাৎ উমর (রা.) আছে? এরপর সে তার সাঙ্গপাঙ্গদের কাছে ফিরে গিয়ে বলে, এরা যারা ছিল তাদের সবাই মারা গেছে।
একথা শুনে হযরত উমর (রা.) নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বলে উঠেন, হে আল্লাহর শত্রু! আল্লাহর কসম! তুমি মিথ্যা বলেছ। যাদের নাম তুমি নিয়েছ তারা সবাই জীবিত আর যেসব বিষয় তোমার কাছে অসহনীয় এমন অনেক কিছুই এখনও তোমার দেখার বাকি।
কিছুক্ষণ পরই মহানবীর (সা.) জ্ঞান ফিরে আসে আর সাহাবীরা যুদ্ধক্ষেত্রের চারিদিকে বার্তাবাহকের মাধ্যমে এই সংবাদ পৌঁছে দেন যেন মুসলমানরা পুনরায় দলবদ্ধ হয়। বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্ন সৈন্যদল পুনরায় একত্রিত হতে আরম্ভ করে এবং মহানবী (সা.) তাদেরকে সাথে নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে চলে যান।
যখন পাহাড়ের পাদদেশে মুসলমান সৈন্যদলের অবশিষ্ট কিছু সৈন্যকে আবু সুফিয়ান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তখন সে বেশ উচ্চস্বরে ঘোষণা দেয়, আমরা মুহাম্মদকে (সা.) হত্যা করেছি।
মহানবী (সা.) আবু সুফিয়ানের এই কথার কোন উত্তর দেননি, পাছে শত্রুরা মুসলমানদের আসল অবস্থা বুঝতে পেরে পুনরায় আক্রমণ করে বসে আর আহত মুসলমানরা পুনরায় শত্রুদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হয়।
ইসলামি সৈন্যদলের কাছ থেকে যখন এই ঘোষণার কোন প্রত্যুত্তর না আসে তখন আবু সুফিয়ানের এই দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নেয় যে, তার ধারণা সঠিক এবং সে বেশ উচ্চস্বরে ঘোষণা দিয়ে বলে, আমরা আবু বকরকেও হত্যা করেছি।
মহানবী (সা.) হজরত আবু বকরকেও (রা.) কোন উত্তর না দেওয়ার আদেশ দেন। এরপর আবু সুফিয়ান ঘোষণা করে, আমরা উমরকেও হত্যা করেছি। এটি শুনে হযরত উমর (রা.), যিনি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ একজন মানুষ ছিলেন, উত্তরে বলে উঠতে উদ্যত হন যে, আমরা আল্লাহতায়ালার কৃপায় জীবিত আছি এবং তোমাদের মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত আছি, কিন্তু মহানবী (সা.) বারণ করে বলেন, মুসলমানদের কষ্টে নিপতিত করো না আর চুপ থাক। তখন কাফিররা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার ডান ও বাম বাহুকেও আমরা মেরে ফেলেছি।
এ কারণে আবু সুফিয়ান এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা আনন্দে ধ্বনি উচ্চকিত করে বলে, ওলো হুবল, ওলো হুবল, অর্থাৎ আমাদের সম্মানিত প্রতিমা হুবলের মর্যাদা উন্নীত হোক, কেননা সে আজ ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
শ্রেষ্ঠনবী (সা.) যিনি তার নিজের মৃত্যুর ঘোষণা এবং হজরত আবু বকর ও উমর (রা.)’র মৃত্যুর ঘোষণা শুনেও নীরব থাকার উপদেশ দিচ্ছিলেন পাছে এমনটি যেন না হয় যে, আহত মুসলমানদের ওপর কাফির সৈন্যরা পুনরায় আক্রমণ করে বসে আর হাতেগোণা মুসলমানরা তাদের হাতে শহীদ হয়ে যায়।
কিন্তু এখন যখন এক ও অদ্বিতীয় খোদার সম্মানের প্রশ্ন দাঁড়ায় এবং শিরকের জয়ধ্বনি উচ্চকিত করা হয় তখন তার অন্তর ব্যাকুল হয়ে যায় আর তিনি (সা.) সাহাবীদের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আবেগের সাথে বলেন, তোমরা উত্তর দিচ্ছ না কেন?
সাহাবীরা বলেন, হে আল্লাহর রসুল (সা.)! আমরা কী বলব? তখন তিনি (সা.) বলেন, বলো! আল্লাহু আ’লা ওয়া আজাল, আল্লাহু আ’লা ওয়া আজাল। (আস সিরাজুল হালবিয়া, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৭০) অর্থাৎ, তোমরা মিথ্যা বলছো, হুবলের মর্যাদা উন্নীত হয়েছে- এটি তোমাদের মিথ্যা কথা বরং এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহই পরম সম্মানিত আর তাঁর সম্মানই অতি মহান।
এভাবে তিনি (সা.) তার জীবিত থাকার সংবাদও শত্রুদের কাছে পৌঁছে দেন। কাফির সৈন্যদের ওপর এই বীরত্বপূর্ণ ও তেজোদ্দীপ্ত উত্তরে শত্রুদের ওপর এত গভীর প্রভাব পড়ে যে, তাদের আশা ভরসা সব মাটিতে মিশে গেল এবং তাদের সামনে হাতেগোণা কয়েকজন আহত মুসলমান দাঁড়িয়ে ছিল যাদের ওপর আক্রমণ করে তাদেরকে মেরে ফেলা জাগতিক হিসেবের দৃষ্টিকোন থেকে একেবারেই সম্ভব ছিল কিন্তু তারা পুনরায় আক্রমণ করার সাহসই দেখাতে পারেনি।
আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সর্বাবস্থায় আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম ও একত্ববাদের প্রচার করার এবং হৃদয়ে ধারণ করার শক্তি দিন, আমিন।
দৈনিক কলম কথা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।